রাষ্ট্রধর্ম ও অন্য ধর্মের অবস্থান

স্বাধীনতা দিবস কেবল-ই গত হলো। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। প্রথমেই বলে নিচ্ছি যে, ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম হওয়ায় এটির পরিমাণ উল্লেখ করলাম না। একই সাথে হিন্দু ছাড়া অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তূলনামূলকভাবে খুবই কম হওয়ায় তাদের পরিমাণগুলোও আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। সংখ্যালঘুদের মাঝে প্রধান হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পরিমাণ যখন কমতে শুরু করে তখন অন্যদেরটা যে বাড়ে না তা সহজেই অনুমেয়। এসব মিলিয়ে হিন্দু ধর্মকেই তুলনার জন্য বেছে নিলাম। যাহোক, ১৯৭৪ সালের সেই আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ছিলো মোট জনসংখ্যার ১৩.৫%। তার ৭ বছর পর ১৯৮১ সালে হয় দ্বিতীয় আদমশুমারি। এবারে হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ১.৩৭ ভাগ কমে দাঁড়ায় ১২.১৩%। এই সাত বছরের মধ্যে চার বছর (১৯৭৮–১৯৮১) ক্ষমতায় ছিলেন যুদ্ধপরাধীদের মুক্তিদাতা, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার অপসারণকারী, সামরিক শাসক ও একনায়ক জিয়াউর রহমান। হিন্দুর সংখ্যা ১.৩৭% কমার কারণটা তাই খুব বিশ্লেষণ না করেই অনুমান করতে পারছি।

অতঃপর ১৯৮৮ সালে, হোমো এরশাদের আমলে আসে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী — আরেক ধাপ এগিয়ে এবার ইসলামকে করা হয় হয় রাষ্ট্রধর্ম। এর তিন বছর পর ১৯৯১ সালে হয় তৃতীয় আদমশুমারি। এবার হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ০.৫১% কমে নেমে হয় ১১.৬২%। আমি ভাবছি একটি সামরিক শাসক ও একনায়কের আমল সংবিধানে করা পরিবর্তন কিভাবে এখনও বৈধ থাকে! ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমানের করা পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়েছে। বিষয়টায় আইনের মারপ্যাচ থাকতে পারে যা সম্পর্কে আমি জানি না।

ক্ষমতার পালাবদল হয়। ১৯১১–১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের ক্ষমতায় থাকেন ১৯৭৭ সালে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দেওয়া ও যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়দাতা জিয়াউর রহমানের পত্নী খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। দশ বছর পর ২০০১ সালের চতুর্থ আদমশুমারিতে সংবিধানের ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’ ধারা অনুযায়ী সকল ধর্মালম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের সুন্দর নিদর্শন দেখা যায় — হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ২.৪২ ভাগ নেমে হয় ৯.২%। উল্লেখ্য, ১৭ বছরে (১৯৭৪–১৯৯১) হিন্দুর সংখ্যা যেখানে ১.৮৮% কমে সেখানে ১০ বছরে (১৯৯১–২০০১) কমে ২.৪২%। কমতির হার অব্যাহত রেখে ২০১১ সালের জরিপে ০.৭ ভাগ কমে হয় ৮.৫%। এই দশ বছরেও বিএনপি-জামাত পাঁচ বছর (২০০১–২০০৬) দেশ শাসন করে। মূলত এই সময়েই বাংলাদেশে জেএমবি ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের দৃষ্টনীয় উত্থান ঘটে যা পুরো সময়টা জুড়ে তৎকালীন সরকার অস্বীকার করে আসে।

উল্লেখ্য, আদমশুমারি কতোটুকু রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে তবুও সংগত কারণেই এটির তথ্যের ওপর আস্থা রাখতেই হয়।

হিন্দু ধর্মাম্বলী এই মানুষগুলো যে ইসলামের শান্তিপূর্ণতার দৃষ্টান্ত দেখে তার সুশীতল ছায়ায় অবস্থান নেয়নি তা তো আমরা সবাই কমবেশি জানি। তাদের বড় অংশ করেছে দেশত্যাগ, অনেকে হয়েছে ধর্মান্তরে বাধ্য। দেশত্যাগের পেছনে রয়েছে ধর্ম পালনে বাধা প্রদান ও সংখ্যালঘু হিসেবে ও হিন্দু হওয়ায় সমাজে ছোট করার প্রবণতাসহ ইত্যাদি নানা কারণ। আর সামনে থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় এই অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছে জামাত ও বিএনপি। এই পুরো প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রধর্ম বা এর প্রবর্তকদের কোনো-ই ভূমিকা নেই, তাই না? আক্ষরিক অর্থে যদি জিজ্ঞেস করেন, সংবিধানে একটি ধারা বাদ বা পরিবর্তন করলে সমাজে কি পরিবর্তন আসতে পারে? কিন্তু এখানে মাথায় রাখা প্রয়োজন যারা এটি প্রবর্তন করেছেনে তাদের মানসিকতা কেমন। মানসিকভাবে এই ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট লোকগুলো যদি ক্ষমতায় থাকে তবে সংবিধান ও আইনের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় এবং তা হয়েছেও। এবং সংখ্যালঘু নিপীড়ন মূলত বেড়েছে এই সব সরকারের আমলেই। সাথে হয়েছে জঙ্গিবাদের উত্থান যা সামাল দিতে বাংলাদেশ এখনও হিমশিম খাচ্ছে।

তবে আগামীকাল (২৮ মার্চ) সুপ্রিম কোর্টে যাই হোক রাষ্ট্রধর্মের প্রথার বিলুপ্তি একদিন হবেই। আদালত যুক্তির পক্ষে — ন্যায়ের নয়, অন্যায়েরও নয়। রাজনৈতিক বা অন্য যে-কোনো কারণে এই বেঞ্চ ব্যর্থ হলে সামনে কোনো এক বেঞ্চে বা অন্য কোনোভাবে রাষ্ট্রধর্মের বিলুপ্তি হবে — কিন্তু এই প্রথার বিলুপ্তি হবেই। হোমো এরশাদের সময়ের আগে ইসলাম এদেশে আরও শক্তভাবে ছিলো। বাস্তবে সত্যিকারের ইসলাম এখন দূর্বল হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে কাঠমোল্লার ইসলাম, সন্ত্রাসবাদী ইসলাম। এসব ঠিক করতে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্মের মতো অযৌক্তিক একটি ধারণা তুলে দেওয়া। প্রথমে রাষ্ট্রকে করতে হবে ধর্মীয় পক্ষপাতমুক্ত এবং তারপর একই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে সমাজ। বর্তমান সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ ভোটের কথা চিন্তা না করে, বিরোধীপক্ষ রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে এটাকে ব্যবহার করবে এটাকে উপেক্ষা করে, তারা হেফাজত ও জামাতের মতো সমমনা সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে শক্ত হাতে দমন করবে।

বাংলাদেশের এই ভৌগলিক অংশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধর্মের আধিপত্য ছিলো। প্রায় সময়ই একজনের আধিপত্যে অপর জনকে নির্যাতিত হতে হয়েছে। দাড়ির ওপর কর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে হাজী শরীয়তউল্লাহ আন্দোলন করেছেন হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে। আজকে তাই হেফাজত বলে এই বাংলা হাজী শরীয়তউল্লাহর বাংলা যেখানে কী না নাস্তিকের ঠাঁই নাই। কিন্তু আপনাদেরকে এভাবে বাড়তে দিলে আপনারা বেড়ে একদিন জিজিয়া করের বাংলা বানাবেন যেখানে টাকা ছাড়া অন্য ধর্মের লোকদের ধর্মের ঠাঁই থাকবে না। যৌক্তিক ও বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে বললে বতর্মান বাংলায় ধর্মান্ধের ঠাঁই নাই। আপনি ধর্মান্ধ মুসলিম হলে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে উট চরান ও উটমূত্র দিয়ে পিপাসা নিবারণ করুন এবং হিন্দু হলে বিজেপির ভারতে গিয়ে গরু চরানোর পাশাপাশি গোমূত্র দিয়ে পিপাসা নিবারণ করুন। বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ ও শান্তিতে থাকতে দিন।

তথ্যসূত্র: আন্তর্জাল

মাদ্রাসা শিক্ষা, সুশিক্ষা, ও মুক্তচিন্তা

তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাড়ায় মুক্ত চিন্তার ক্ষমতা। সুশিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে সচেতনতার হার, বাড়ে যুক্তি দিয়ে কাজ ও চিন্তা করার ক্ষমতা, এবং কমে অন্ধ বিশ্বাসের পরিধি।

কোরআন, গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেলের মতো গ্রন্থ যে পবিত্র তা আমরা জন্ম থেকে জেনে আসি না। কেউ পরিচয় না করিয়ে দিলে ধর্ম কি তা আমরা জানতাম না। জন্মের পর আমাদের আশেপাশের মানুষ-ই আমাদেরকে এসবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আর আমরা প্রায় সবাই ধর্ম না বুঝে শুধুমাত্র তাদের ওপর আস্থা রেখেই তা মানা শুরু করেছি। ধর্মের ব্যাপারে শুরু থেকেই শোনা কথার ওপর আস্থা রাখার এই মানসিকতা আমাদের আজও রয়ে গেছে। নিজে পড়ে ও বুঝে ধর্ম পালনের চেয়ে আজও আমরা হুজুরদের শরণাপন্ন হই। এখন চরমোনাইয়ের পীরও ‘হুজুর’, দেওয়ানবাগীও ‘হুজুর’। আর ভক্তকুল তাদের হুজুর ও পাতি হুজুরদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও নির্দেশনা ইসলামের আলোকে যাচাই না করেই হুজুরের ওপর থাকা অগাধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে একে অপরকে ধুয়ে ফেলছে। অথচ ইসলাম পথভ্রষ্টতা প্রতিরোধে হুজুরদের কথা শোনার ওপর জোর দেয়নি, বলেছে কোরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে। কিন্তু এ তো জানা কথা যে, এতো বড় কোরআন আর মোটা মোটা হাদিসের বই পড়া থেকে আধা ঘণ্টা হুজুরের কথা শোনা ঢের সময় বাঁচোয়া। আর ধর্মের ব্যাপারে মনোবল বাড়ায় বিশ্বাস, যুক্তি-প্রমাণ নয়।

ধর্মীয় অনুশাসন শিক্ষা দেওয়া অন্যায় নয়। কিন্তু কওমী মাদ্রাসাগুলোতে সারাদিন ধর্মীয় শিক্ষায় ও অনুশাসনে একটি শিশুর মস্তিষ্ক ব্যস্ত রেখে, তাঁর স্বাভাবিক ও মুক্ত চিন্তাকে বাধাগ্রস্থ করে তাঁকে মানসিকভাবে একপেশে করা হয়। আমরা জানি, শিশুর মানসিক বৃদ্ধি তাঁর আশেপাশের পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। এখানে ছয়-সাত বছর বয়সের একটি শিশুর প্রতিদিনকার জীবন মসজিদে পাতা বিছানা থেকে সূর্য উদয়ের আগেই উঠে শুরু হয় এবং সারা দিন পবিত্র কোরআন ও ধর্মীয় পুস্তক পড়ে, ও হুজুরদের সেবাযত্ন করে শেষ হয়। এই শিক্ষা তাঁকে শেখায় অন্য সকল আদর্শকে উপেক্ষা করতে ও সবকিছু এককেন্দ্রিকভাবে চিন্তা করতে, কিন্তু মুক্ত বিবেকের আলোকে নয়। আর এই শিক্ষা গ্রহণ করতে করতেই তার মানসিক বিকাশের সময় পার হয়ে যায়। তাই পরবর্তীতে বড় হওয়ার পর ঐ শিশুটির কাছ থেকে আমাদের এমনটি আশা করা অন্যায় হবে যে, একদিন সে ঐ জীবনে পাওয়া শিক্ষা দ্বারা তৈরি চিন্তাধারাকে পাশ কাটিয়ে কোনো বিষয়ে চিন্তা করতে পারবে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এভাবেই কওমী মাদ্রাসায় একটি শিশুর মানসিকতা বিকাশ ও শিক্ষা জীবনের মূল্যবান সময়টি অনুমোদনহীন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানহীন একপেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে নষ্ট হয় — আর এ দায় যার ওপর বর্তাতে পারতো সে হয়তো শিশুটির মাদ্রাসা শিক্ষাকে বলিদানের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। কারণ ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য অনেকে তাঁর সন্তানকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেন।

বর্তমান বাংলার প্রয়োজন প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন বিষয়ে কারীগরী জ্ঞানসম্পন্ন পেশাজীবি। অর্থনৈতিক দিক থেকে চিন্তা করলে, প্রতি বছর বের হওয়া হাজার হাজার হাফেজ দিয়ে এই বাংলার এগিয়ে চলা সম্ভব নয়। বছরে একবার বিশ রাকাত তারাবীর নামাজ পড়ানো ছাড়া আর কোন কাজে তাঁদের বিশেষ ব্যবহার চোখে পড়ে না। না পারেন তাঁরা নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন করতে, না পারেন সামষ্টিকভাবে দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে (মানছি, কিছু ইমাম আমরা প্রতি বছর রপ্তানি করি)। অনেকে যদিও এই শিক্ষাক্রমের আওতায় শুরু করেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বেরিয়ে আসছেন, কিন্তু তার সংখ্যা খুব বেশি নয়। আর অনেকে তো বেরিয়েও আসতে পারছেন না।

আস্তিকতার মূলভিত্তি বিশ্বাস, আর নাস্তিকতার যুক্তি। তাই আস্তিকতার পথে মূর্খও যেতে পারে, কিন্তু নাস্তিক হতে পড়াশোনা করা লাগে। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অশিক্ষিত আস্তিকের চেয়ে শিক্ষিত নাস্তিকের উপস্থিতি বেশি কাম্য। সবার মস্তিষ্কের ওজনই কমবেশি দেড় কেজি, কিন্তু সবার মাথার দাম সমান নয়। আজ শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসকে আমলে নিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে নাস্তিক হটাও আন্দোলনে করছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, বাংলার রাজত্ব পরিবর্তনশীল। অনুন্নত বাংলায় কালক্রমে বৌদ্ধ ও হিন্দুরা রাজত্ব করে গেছে। উন্নয়নশীল বাংলায় এখন মুসলিমরা রাজত্ব করছে। উন্নত বাংলার রাজত্ব কার হবে তা সময়-ই বলে দেবে।

ধর্মপ্রচার

‘ইহুদী-নাসারা’ সম্বোধনটির ব্যবহার যে নেতিবাচক তা মসজিদে গমনকারী প্রায় সকলেই জানেন। বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত বলেই আপনাদের অনেকের বাসায় হয়তো মাঝে মাঝে তাবলীগ জামাতের মানুষ দেখা দেয়, যাঁদের উদ্দেশ্য থাকে ধর্মের বাণী প্রচার — একজন মুসলিমকে ইসলামের আদর্শের পথে টানা।

অনেকে ব্যাপারটিকে ভালো হিসেবে দেখেন, অনেকে দেখেন বিরক্তিকর হিসেবে; আমি দেখি স্বাভাবিক হিসেবে। বিশ্বাস একজনের কাছে থেকে জন্ম নিয়ে তার প্রচার ও শক্তির জোরে একাধিক মানুষের কাছে ছড়িয়ে যায়। এজন্য বাংলাদেশে আজ কোটি কোটি মুসলিম, লাখ লাখ আওয়ামীলীগার।

  • নিজের মনের ভাব বা বিশ্বাস প্রকাশের অধিকার মানুষের আছে।
  • বিশ্বাস ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রচারের দরকার আছে।
  • আর মানুষের আছে বিশ্বাস পরিবর্তন, গ্রহণ, বা বর্জন করার অধিকার।

এই তিনটি ব্যাপার খুবই মৌলিক।

নাস্তিক্যবাদ যাঁরা দেখতে পারেন না, তাঁদের অনেকেই নাস্তিকদের মেনে নিলেও নাস্তিক্যবাদের প্রচারে খুবই আপত্তি আছে তাঁদের। তাঁরা ভীত এতে নাস্তিকের সংখ্যা বাড়বে, নাস্তিকরা শক্তিশালী হবে।

বাংলাদেশের মাটি হাজার-হাজার বছরের পুরোনো। ইসলাম অধ্যুষিত হওয়ার আগে এই মাটি ছিলো হিন্দু অধ্যুষিত। আজ আমরা যেই হিন্দুদের সংখ্যালঘু বলি, এক কালে তাঁরাই ছিলেন সংখ্যাগুরু। সে সময় ভিনদেশী ইসলাম প্রচারকগণ যখন এখানে এসেছিলেন তাঁরাই বরং ছিলেন সংখ্যালঘু। তাঁরা তাঁদের নিজেদের বিশ্বাস প্রচার করেছিলেন, মানুষ তাঁদের বিশ্বাস গ্রহণ করা শুরু করেছিলো দলে দলে। এক-দুই জন করে আসা এই ধর্মপ্রচারকদের দল ভারী হচ্ছিলো।

সেদিনও এক প্রকার মানুষ ছিলো যাঁরা ইসলাম দেখতে পারতেন না। মুসলিমদের অনেক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখতেন, চাপে রাখতেন। তাঁরা ভীত ছিলেন চাপে না রাখলে একদিন মুসলিমরা শক্তিশালী হবে।

আজ আমরা সবাই জানি সেই চাপ কাজে আসেনি। দাড়ির ওপর কর ধার্য করে মুসলিম জাগরণ ঠেকানো যায়নি। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ আজ মুসলিম।

  • কারও কাছে ‘ইহুদী-নাসারা’ নেতিবাচক, কারও কাছে নেতিবাচক হচ্ছে ‘মৌলবাদী’।
  • কারও কাছে ‘লীগপন্থী’ নেতিবাচক, কারও কাছে নেতিবাচক হচ্ছে ‘জামাতি’।

প্রথমটির ক্ষেত্র ধর্ম, আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্র রাজনীতি। দু’টোই বিশ্বাস। একটি ধর্মীয়, অপরটি রাজনৈতিক। সবগুলো বিশ্বাস-ই ছড়িয়েছে মানুষের হাত ধরে, প্রচারের মাধ্যমে। আর বিশ্বাসের জের ধরেই এক পক্ষ অপর পক্ষের চোখের বালি।

সামনে নির্বাচন আসছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলত্যাগের কিছু ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে। সচারচর প্রতিবার আমরা যা দেখি তা হলো, ‘ক’ দল ত্যাগকারী ব্যক্তিকে তাঁর সদ্য যোগদানকৃত ‘খ’ দলের ব্যক্তিবর্গ ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন এবং ‘ক’ দলের ব্যক্তিবর্গ ঐ দল পরিত্যাগকারী ব্যক্তির নামে কুৎসা রটানো শুরু করেন।

আজ একটি মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে আপনি সাধুবাদ দেন, আর ইসলাম ত্যাগ করে নাস্তিক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করলে মুর্দাবাদ বলে তাঁকে ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাবলীগ জামাতের ইসলাম প্রচারে আপনার সমস্যা হয় না, কিন্তু নাস্তিক্যবাদের প্রচার ঠেকাতে আপনি ব্লাসফেমি আইন চান।

পরিশেষে, আইন দিয়ে বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নিজের পথ বেছে নেওয়ার অধিকার প্রত্যেকটি মানুষের আছে এবং সেই সাথে আছে বিশ্বাস প্রচারের অধিকার। ঠিক যেমন মুসলিম হিসেবে ইসলাম প্রচারের অধিকার আপনার আছে।

ইসলাম ও তার বিজ্ঞ অনুসারীগণ

শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারীগণ অতিশয় সক্রিয় মৌল। আফসোস — ইসলাম, অনুসারীদের কারণে তুমি আজ সোনার বদলে পটাশিয়াম হইয়া গিয়াছো; এখন বাতাস — তা উড়ো বা ঝড়ো যাই হোক না কেনো, সংস্পর্শে আসিলেই তুমি দুমদাম ফুটিতে থাকো।

তোমার ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন। তোমার অনুসারীগণ পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ অবলীলায় ভুলিয়া যায়, কিন্তু ঈদের ওয়াজিব নামাজ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করিয়া থাকে, এবং যাহারা তা পালন করিতে ব্যর্থ হয় তাহাদিগকে তিরষ্কার করিয়া থাকে। শূকরের মাংস বিক্রয় ও ভক্ষণ তোমার অনুসারীগণ অতি ঘৃণার চোখে দেখে, কিন্তু ঘুষ খাইয়া বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হইয়া ট্রফি লইয়া ঘরে ফিরে। আর তোমার নবীজির কথা কি বলিবো? .. বিজ্ঞ অনুসারীগণ তোমার একমাত্র নবীর প্রেমে জীবন দিয়া দিতেছে, কিন্তু তাহার সুন্নতের দিকে ভ্রুক্ষেপ করার কথা তাহাদের ইয়াদে নাই।

ইসলাম, অতীতে যে মর্যাদা ও সম্মান নিয়া তুমি বিশ্বের একটা বড় অংশ শাসন করিয়াছো, তোমার সেই মর্যাদা আজ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর একটি ভিডিওর কারণে হুমকির মুখে পড়িয়াছে। আর সেই হুমকির নিরসনকল্পে তোমার অনুসারীগণ তোমার আপন গোত্রীয় ভ্রাতাদিগকেই বাঁশ দিতেছে।

বিজ্ঞদের মুখে শুনিয়াছি মানুষের জন্য নাকি ধর্ম। অথচ তোমার জন্য আজ মানবতা থেকে ধর্ম বড় হইয়া গিয়াছে। মানুষ এখন সমানে হিটলারের বাছবিচারহীন ইহুদি নিধন সমর্থন করিতেছে ও তদীয় ছবি ইহুদি পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এক নাস্তিকের সৃষ্ট ও পরিচালিত ফেসবুকে শেয়ার করিতেছে।

ইসলাম, ফেসবুকের কথা আর কি বলিবো? তোমার ঈমানের চাষ এখন মসজিদের চাইতে ফেসবুকেই বেশি হইতেছে। মানুষ এখন বাস্তবে তোমার কুরআন হাত লওয়ার চাইতে ফেসবুকেই এ বিষয়ক ভালোবাসা প্রমাণ করিতেছে ও ইহার প্রমাণ স্বরূপ “আমি কুরআনে পাকের প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রমাণের জন্য ৯,৯৯৯,৯৯৯টি ফ্যান চাই” শীর্ষক পাতায় সমানে লাইক মারিতেছে ও মারিতে উদ্বুদ্ধ করিতেছে।

তোমার জন্য তোমার বিজ্ঞ অনুসারীগণ আজ নির্বোধ হইয়াছে। তথাকথিত ইহুদি-নাছারাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করিতে গিয়া তাহারা নিজেদের জানমাল ও শিক্ষার বারোটা বাজাইয়া দিতেছে। একটি ভিডিওর দোহাইয়া দিয়া ১২ কোটির বেশি ভিডিও থাকা একটি ওয়েবসাইট বন্ধ করিতে গিয়াছে এবং তাহাতে হিমশিম খাইয়া সাথে আরও গণ্ডাখানেক ওয়েবসাইট বন্ধ করিয়া সকলের হাসি ও বিরক্তির পাত্র হইয়াছে।

বলার তো আরও অনেক কিছুই ছিলো..

তবে পরিশেষে, মুসলিম উম্মাহ, জন্মসূত্রে তুমি ধর্মটাই পাইয়াছো, কেবল বুদ্ধি আর শিক্ষাটাই আর অর্জন করিতে পারো নাই। এ অবস্থায় সকল ফালাফালি ছাপাইয়া পরাজয় তোমার সুনিশ্চিত — ইহা জানিয়া রাখো। তাই তথাকথিত ইহুদি-নাছারাদের সুবুদ্ধির প্রার্থনার আগে তোমার সুবুদ্ধির প্রার্থনাই এখন বেশি জরুরী হইয়া গিয়াছে। কারণ শুধুমাত্র বিবেচনাহীন বুলি ও ফেসবুকের ছবি শেয়ার সম্বলিত অন্ধ ঈমানের কারণে তোমার আল্লাহ অকর্মণ্য নির্বোধকে কখনই উঠাইয়া বা বাঁচাইয়া দিবেন না।