মাদ্রাসা শিক্ষা, সুশিক্ষা, ও মুক্তচিন্তা

তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাড়ায় মুক্ত চিন্তার ক্ষমতা। সুশিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে সচেতনতার হার, বাড়ে যুক্তি দিয়ে কাজ ও চিন্তা করার ক্ষমতা, এবং কমে অন্ধ বিশ্বাসের পরিধি।

কোরআন, গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেলের মতো গ্রন্থ যে পবিত্র তা আমরা জন্ম থেকে জেনে আসি না। কেউ পরিচয় না করিয়ে দিলে ধর্ম কি তা আমরা জানতাম না। জন্মের পর আমাদের আশেপাশের মানুষ-ই আমাদেরকে এসবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আর আমরা প্রায় সবাই ধর্ম না বুঝে শুধুমাত্র তাদের ওপর আস্থা রেখেই তা মানা শুরু করেছি। ধর্মের ব্যাপারে শুরু থেকেই শোনা কথার ওপর আস্থা রাখার এই মানসিকতা আমাদের আজও রয়ে গেছে। নিজে পড়ে ও বুঝে ধর্ম পালনের চেয়ে আজও আমরা হুজুরদের শরণাপন্ন হই। এখন চরমোনাইয়ের পীরও ‘হুজুর’, দেওয়ানবাগীও ‘হুজুর’। আর ভক্তকুল তাদের হুজুর ও পাতি হুজুরদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও নির্দেশনা ইসলামের আলোকে যাচাই না করেই হুজুরের ওপর থাকা অগাধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে একে অপরকে ধুয়ে ফেলছে। অথচ ইসলাম পথভ্রষ্টতা প্রতিরোধে হুজুরদের কথা শোনার ওপর জোর দেয়নি, বলেছে কোরআন ও সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে। কিন্তু এ তো জানা কথা যে, এতো বড় কোরআন আর মোটা মোটা হাদিসের বই পড়া থেকে আধা ঘণ্টা হুজুরের কথা শোনা ঢের সময় বাঁচোয়া। আর ধর্মের ব্যাপারে মনোবল বাড়ায় বিশ্বাস, যুক্তি-প্রমাণ নয়।

ধর্মীয় অনুশাসন শিক্ষা দেওয়া অন্যায় নয়। কিন্তু কওমী মাদ্রাসাগুলোতে সারাদিন ধর্মীয় শিক্ষায় ও অনুশাসনে একটি শিশুর মস্তিষ্ক ব্যস্ত রেখে, তাঁর স্বাভাবিক ও মুক্ত চিন্তাকে বাধাগ্রস্থ করে তাঁকে মানসিকভাবে একপেশে করা হয়। আমরা জানি, শিশুর মানসিক বৃদ্ধি তাঁর আশেপাশের পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। এখানে ছয়-সাত বছর বয়সের একটি শিশুর প্রতিদিনকার জীবন মসজিদে পাতা বিছানা থেকে সূর্য উদয়ের আগেই উঠে শুরু হয় এবং সারা দিন পবিত্র কোরআন ও ধর্মীয় পুস্তক পড়ে, ও হুজুরদের সেবাযত্ন করে শেষ হয়। এই শিক্ষা তাঁকে শেখায় অন্য সকল আদর্শকে উপেক্ষা করতে ও সবকিছু এককেন্দ্রিকভাবে চিন্তা করতে, কিন্তু মুক্ত বিবেকের আলোকে নয়। আর এই শিক্ষা গ্রহণ করতে করতেই তার মানসিক বিকাশের সময় পার হয়ে যায়। তাই পরবর্তীতে বড় হওয়ার পর ঐ শিশুটির কাছ থেকে আমাদের এমনটি আশা করা অন্যায় হবে যে, একদিন সে ঐ জীবনে পাওয়া শিক্ষা দ্বারা তৈরি চিন্তাধারাকে পাশ কাটিয়ে কোনো বিষয়ে চিন্তা করতে পারবে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এভাবেই কওমী মাদ্রাসায় একটি শিশুর মানসিকতা বিকাশ ও শিক্ষা জীবনের মূল্যবান সময়টি অনুমোদনহীন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানহীন একপেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে নষ্ট হয় — আর এ দায় যার ওপর বর্তাতে পারতো সে হয়তো শিশুটির মাদ্রাসা শিক্ষাকে বলিদানের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। কারণ ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য অনেকে তাঁর সন্তানকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেন।

বর্তমান বাংলার প্রয়োজন প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন বিষয়ে কারীগরী জ্ঞানসম্পন্ন পেশাজীবি। অর্থনৈতিক দিক থেকে চিন্তা করলে, প্রতি বছর বের হওয়া হাজার হাজার হাফেজ দিয়ে এই বাংলার এগিয়ে চলা সম্ভব নয়। বছরে একবার বিশ রাকাত তারাবীর নামাজ পড়ানো ছাড়া আর কোন কাজে তাঁদের বিশেষ ব্যবহার চোখে পড়ে না। না পারেন তাঁরা নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন করতে, না পারেন সামষ্টিকভাবে দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে (মানছি, কিছু ইমাম আমরা প্রতি বছর রপ্তানি করি)। অনেকে যদিও এই শিক্ষাক্রমের আওতায় শুরু করেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বেরিয়ে আসছেন, কিন্তু তার সংখ্যা খুব বেশি নয়। আর অনেকে তো বেরিয়েও আসতে পারছেন না।

আস্তিকতার মূলভিত্তি বিশ্বাস, আর নাস্তিকতার যুক্তি। তাই আস্তিকতার পথে মূর্খও যেতে পারে, কিন্তু নাস্তিক হতে পড়াশোনা করা লাগে। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অশিক্ষিত আস্তিকের চেয়ে শিক্ষিত নাস্তিকের উপস্থিতি বেশি কাম্য। সবার মস্তিষ্কের ওজনই কমবেশি দেড় কেজি, কিন্তু সবার মাথার দাম সমান নয়। আজ শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসকে আমলে নিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে নাস্তিক হটাও আন্দোলনে করছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, বাংলার রাজত্ব পরিবর্তনশীল। অনুন্নত বাংলায় কালক্রমে বৌদ্ধ ও হিন্দুরা রাজত্ব করে গেছে। উন্নয়নশীল বাংলায় এখন মুসলিমরা রাজত্ব করছে। উন্নত বাংলার রাজত্ব কার হবে তা সময়-ই বলে দেবে।