রাষ্ট্রধর্ম ও অন্য ধর্মের অবস্থান

স্বাধীনতা দিবস কেবল-ই গত হলো। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। প্রথমেই বলে নিচ্ছি যে, ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম হওয়ায় এটির পরিমাণ উল্লেখ করলাম না। একই সাথে হিন্দু ছাড়া অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তূলনামূলকভাবে খুবই কম হওয়ায় তাদের পরিমাণগুলোও আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। সংখ্যালঘুদের মাঝে প্রধান হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পরিমাণ যখন কমতে শুরু করে তখন অন্যদেরটা যে বাড়ে না তা সহজেই অনুমেয়। এসব মিলিয়ে হিন্দু ধর্মকেই তুলনার জন্য বেছে নিলাম। যাহোক, ১৯৭৪ সালের সেই আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ছিলো মোট জনসংখ্যার ১৩.৫%। তার ৭ বছর পর ১৯৮১ সালে হয় দ্বিতীয় আদমশুমারি। এবারে হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ১.৩৭ ভাগ কমে দাঁড়ায় ১২.১৩%। এই সাত বছরের মধ্যে চার বছর (১৯৭৮–১৯৮১) ক্ষমতায় ছিলেন যুদ্ধপরাধীদের মুক্তিদাতা, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার অপসারণকারী, সামরিক শাসক ও একনায়ক জিয়াউর রহমান। হিন্দুর সংখ্যা ১.৩৭% কমার কারণটা তাই খুব বিশ্লেষণ না করেই অনুমান করতে পারছি।

অতঃপর ১৯৮৮ সালে, হোমো এরশাদের আমলে আসে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী — আরেক ধাপ এগিয়ে এবার ইসলামকে করা হয় হয় রাষ্ট্রধর্ম। এর তিন বছর পর ১৯৯১ সালে হয় তৃতীয় আদমশুমারি। এবার হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ০.৫১% কমে নেমে হয় ১১.৬২%। আমি ভাবছি একটি সামরিক শাসক ও একনায়কের আমল সংবিধানে করা পরিবর্তন কিভাবে এখনও বৈধ থাকে! ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমানের করা পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়েছে। বিষয়টায় আইনের মারপ্যাচ থাকতে পারে যা সম্পর্কে আমি জানি না।

ক্ষমতার পালাবদল হয়। ১৯১১–১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের ক্ষমতায় থাকেন ১৯৭৭ সালে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দেওয়া ও যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়দাতা জিয়াউর রহমানের পত্নী খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। দশ বছর পর ২০০১ সালের চতুর্থ আদমশুমারিতে সংবিধানের ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’ ধারা অনুযায়ী সকল ধর্মালম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের সুন্দর নিদর্শন দেখা যায় — হিন্দু জনসংখ্যার পরিমাণ ২.৪২ ভাগ নেমে হয় ৯.২%। উল্লেখ্য, ১৭ বছরে (১৯৭৪–১৯৯১) হিন্দুর সংখ্যা যেখানে ১.৮৮% কমে সেখানে ১০ বছরে (১৯৯১–২০০১) কমে ২.৪২%। কমতির হার অব্যাহত রেখে ২০১১ সালের জরিপে ০.৭ ভাগ কমে হয় ৮.৫%। এই দশ বছরেও বিএনপি-জামাত পাঁচ বছর (২০০১–২০০৬) দেশ শাসন করে। মূলত এই সময়েই বাংলাদেশে জেএমবি ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের দৃষ্টনীয় উত্থান ঘটে যা পুরো সময়টা জুড়ে তৎকালীন সরকার অস্বীকার করে আসে।

উল্লেখ্য, আদমশুমারি কতোটুকু রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে তবুও সংগত কারণেই এটির তথ্যের ওপর আস্থা রাখতেই হয়।

হিন্দু ধর্মাম্বলী এই মানুষগুলো যে ইসলামের শান্তিপূর্ণতার দৃষ্টান্ত দেখে তার সুশীতল ছায়ায় অবস্থান নেয়নি তা তো আমরা সবাই কমবেশি জানি। তাদের বড় অংশ করেছে দেশত্যাগ, অনেকে হয়েছে ধর্মান্তরে বাধ্য। দেশত্যাগের পেছনে রয়েছে ধর্ম পালনে বাধা প্রদান ও সংখ্যালঘু হিসেবে ও হিন্দু হওয়ায় সমাজে ছোট করার প্রবণতাসহ ইত্যাদি নানা কারণ। আর সামনে থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় এই অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছে জামাত ও বিএনপি। এই পুরো প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রধর্ম বা এর প্রবর্তকদের কোনো-ই ভূমিকা নেই, তাই না? আক্ষরিক অর্থে যদি জিজ্ঞেস করেন, সংবিধানে একটি ধারা বাদ বা পরিবর্তন করলে সমাজে কি পরিবর্তন আসতে পারে? কিন্তু এখানে মাথায় রাখা প্রয়োজন যারা এটি প্রবর্তন করেছেনে তাদের মানসিকতা কেমন। মানসিকভাবে এই ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট লোকগুলো যদি ক্ষমতায় থাকে তবে সংবিধান ও আইনের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় এবং তা হয়েছেও। এবং সংখ্যালঘু নিপীড়ন মূলত বেড়েছে এই সব সরকারের আমলেই। সাথে হয়েছে জঙ্গিবাদের উত্থান যা সামাল দিতে বাংলাদেশ এখনও হিমশিম খাচ্ছে।

তবে আগামীকাল (২৮ মার্চ) সুপ্রিম কোর্টে যাই হোক রাষ্ট্রধর্মের প্রথার বিলুপ্তি একদিন হবেই। আদালত যুক্তির পক্ষে — ন্যায়ের নয়, অন্যায়েরও নয়। রাজনৈতিক বা অন্য যে-কোনো কারণে এই বেঞ্চ ব্যর্থ হলে সামনে কোনো এক বেঞ্চে বা অন্য কোনোভাবে রাষ্ট্রধর্মের বিলুপ্তি হবে — কিন্তু এই প্রথার বিলুপ্তি হবেই। হোমো এরশাদের সময়ের আগে ইসলাম এদেশে আরও শক্তভাবে ছিলো। বাস্তবে সত্যিকারের ইসলাম এখন দূর্বল হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে কাঠমোল্লার ইসলাম, সন্ত্রাসবাদী ইসলাম। এসব ঠিক করতে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্মের মতো অযৌক্তিক একটি ধারণা তুলে দেওয়া। প্রথমে রাষ্ট্রকে করতে হবে ধর্মীয় পক্ষপাতমুক্ত এবং তারপর একই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে সমাজ। বর্তমান সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ ভোটের কথা চিন্তা না করে, বিরোধীপক্ষ রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে এটাকে ব্যবহার করবে এটাকে উপেক্ষা করে, তারা হেফাজত ও জামাতের মতো সমমনা সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোকে শক্ত হাতে দমন করবে।

বাংলাদেশের এই ভৌগলিক অংশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধর্মের আধিপত্য ছিলো। প্রায় সময়ই একজনের আধিপত্যে অপর জনকে নির্যাতিত হতে হয়েছে। দাড়ির ওপর কর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে হাজী শরীয়তউল্লাহ আন্দোলন করেছেন হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে। আজকে তাই হেফাজত বলে এই বাংলা হাজী শরীয়তউল্লাহর বাংলা যেখানে কী না নাস্তিকের ঠাঁই নাই। কিন্তু আপনাদেরকে এভাবে বাড়তে দিলে আপনারা বেড়ে একদিন জিজিয়া করের বাংলা বানাবেন যেখানে টাকা ছাড়া অন্য ধর্মের লোকদের ধর্মের ঠাঁই থাকবে না। যৌক্তিক ও বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে বললে বতর্মান বাংলায় ধর্মান্ধের ঠাঁই নাই। আপনি ধর্মান্ধ মুসলিম হলে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে উট চরান ও উটমূত্র দিয়ে পিপাসা নিবারণ করুন এবং হিন্দু হলে বিজেপির ভারতে গিয়ে গরু চরানোর পাশাপাশি গোমূত্র দিয়ে পিপাসা নিবারণ করুন। বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ ও শান্তিতে থাকতে দিন।

তথ্যসূত্র: আন্তর্জাল